একটি পেন্ডিং ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৪)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১২:৪৯:০৪ দুপুর
৪.
অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে শিহাব নেটে ঢু মারে।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুক ইউজ করে নাকি নেট ইউজের ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে বলা মুশকিল। তবে তার বসের রুমে বকা খাওয়ার জন্য এখনো পর্যন্ত ডাক পড়ে নাই । অফিসের নেট ব্যবহার করে না। নিজের জন্য আলাদা মডেমে ‘হেভী ব্রাউজিং প্যাকেজ’ রয়েছে।
আজও অনেক ভোরে আসতে হয়েছে। হরবোধ (হরতাল + অবরোধ) চলছে। অফিসের গাড়ি আপাতত বন্ধ। যে যার মত আসছে। তবে এর ভিতরেও অনেক ভোরে বসদের মাইক্রো আসে কদাচিত। শিহাবের চেম্বার আলাদা। একজন কম্পিউটার অপারেটর যে কোয়ালিটি রিপোর্টগুলো করে, সে আগে ওর রুমের ভিতরে ছিল। কিন্তু একা থাকতে অভ্যস্ত শিহাব পরবর্তিতে তাকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়।
আজ ল্যাপটপে জেমস এর ‘অনন্যা’ গানটি ছেড়ে শুনছিল। বেশ পুরনো কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই গানের সাথে। সেই খুলনা বি এল কলেজের (পরবর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) ক্যাম্পাস... নির্দিষ্ট একজন... কিছু প্রগলভ অনুভুতি... হৃদয়ের রক্তক্ষরণ... সব হারানোর বেদনা...
আহ!!
এতোদিন পরে একটা গান কিভাবে কষ্টগুলোকে একটা বন্ধ দরোজা ভেঙ্গে বের করে নিয়ে এলো! স্মৃতির উপরে স্মৃতি আর ধুলো জমে জমে সেটাকে এতোটা পুরু করে দিয়েছিল যে, সে ভুলেই গেছিলো হিরণ্ময় সোনালী অতীতকে।
অতীত? তারও যে একটা অতীত আছে ভুলেই বসে আছে। আর ভুলবেই বা না কেন? জীবন তাকে নিয়ে কি আর কম টানা হেঁচড়া করেছে। এখন জেসমিন এবং দুই মেয়ে ছাড়া আর কিছু সে ভেবে উঠতে পারে না।
জেমস গেয়ে যাচ্ছে-
‘ভেবে ভেবে তোমার কথা উদাস হয়ে...
এই তুমি কি জেসমিন? ... নাকি অনন্যা?
যতই অতীতকে ভুলে থাকতে চাক, এক লাফে নীলা নামের এক ‘অনন্যা’ আজ এই গানের সাথে সাথে ওর চেম্বারে প্রবেশ করে। ওর হৃদয়ের বন্ধ জানালায় উঁকি মেরে চলে যাওয়া এক বিচ্ছিন্ন অতীত হলেও ক্ষতি ছিল না। কিন্তু সে যে দাঁড়িয়ে রইলো!
একটা গান এভাবে ওকে ওলটপালট করে দিবে ভাবতেই পারছে না।
‘... কতদিন কত রাত্রি গিয়েছে পেরিয়ে
কভু আনমনে ছুঁয়ে গেছ তুমি লাজুক দৃষ্টি নিয়ে...’
খুলনায় পড়াকালীন নীলার সাথে দিনের পর দিন... বিনিদ্র রজনী থেকে থেকে কখন যে সে শিহাবের হৃদয়কে লাজুক দৃষ্টি দিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছিল- সেই ক্ষণটিকে হাজার চেষ্টা করেও আজ মনে করতে পারছে না। তবে অনুভুতির প্রগাঢ়তাকে ছাড়িয়েও আরো কি একটা বোধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চকিতে উঁকি মেরে চলে যাচ্ছে।
‘... কতভাবে ভেবেছি বলবো তোমাকে
পেয়েছি খুঁজে ভালবাসা আমি অবুঝ তোমার চোখে...’
কিন্তু সেই কথাটিই নীলাকে বলা হয়নি। তার আগেই সে ওকে ছেড়ে অন্য একজনের হাত ধরে সব কিছু ছেড়ে চলে গেলো।
‘... তুমি যে আমার বুকের গভীরে আমার রক্তের প্রতিটি অণুতে অণুতে
প্রতিটি কোষে অনুভবে আছো মিশে...’
হ্যা... একসময় ওর সমগ্র সত্তায় নীলা জুড়ে ছিল। প্রতিটি অণুতে অণুতে...
আজ কি নেই?
অস্থির হয়ে গান বন্ধ করে দেয় শিহাব। কিন্তু যে স্মৃতিকে আজ এতো বছর পরে ধুলো সরিয়ে সামনে নিয়ে এসেছে- এতো সহজেই কি তা চলে যাবে। যেচে পড়ে বেদনাকেই কি টেনে আনলো না সে?
যে বেদনাকে ভুলানোর জন্য দিন-রাত-মাস-বছর অস্থির দৌড়ে বেড়িয়েছে... চায়ের দোকান থেকে শুরু করে পুর্বাণী হোটেলের ড্যান্স ফ্লোর হয়ে বস্তির ঝুপড়ি ঘরের নেশার আস্তানা আর... আরো কত যায়গায় যে সে মুক্তি খুঁজে বেড়িয়েছে!!
অবশেষে জেসমিন এসেছিলো তার মুক্তির বার্তাবাহক হয়ে।
হৃদয়ের ক্ষতটাকে সামলে নিতে যদিও জেসমিনের হাতের কোমল পরশ তখন দরকার ছিল। কিন্তু এই একটা অধ্যায়কে সে একান্ত নিজের করে রেখেছে... আজ পর্যন্ত। জেসমিনকেও বুঝতে দেয় নাই। কিন্তু কিছুটা কি সে বুঝে নাই?
দুজন মানুষ যখন একটা পবিত্র বন্ধনে জড়িয়ে যায় সারা জীবনের জন্য তখন কি তাঁরা না বলা কথাকেও উপলব্ধি করতে পারে না? ওর মনের শুন্যতাকে কি জেসমিন বুঝতে পেরেছে...??
সুন্দর একটা জীবন... একদিকে বয়ে যাওয়া একটা লাইফস্টাইলকে বিষাদময় একটি গান একটু হলেও এলোমেলো করে দিতে চেষ্টা করে গেলো এই মাত্র... সাভার ইপিজেডের এক ফ্যাক্টরীর একজন সহকারী মান-নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাপকের চেম্বারে।
... ...
মন খারাপের এক বিকেলে নীলার এক চিলতে অঙ্গন- বারান্দায় বসে থেকে ইকবালকে গাড়ি নিয়ে বাসার মেইন গেটে ঢুকতে দেখল। নির্লিপ্ত ভাবেই দেখে।
এখন ইকবাল আর ওর ভিতরে যে সম্পর্কটা চলছে সেটাকে কি নাম দেয়া যায়?
আদৌ কি কোনো কিছু আছে? শুধু একটা শরীরের? আর একটা শরীরকে যে জন্য প্রয়োজন হয়, ওকেও ইকবালের সেই কাজে লাগে। তাও নিজের মর্জি মাফিক...
এখানে কোনো সম্পর্ক তৈরী হতে পারে না।
ডোরবেলের আওয়াজে চিন্তার রেশ কেটে যায়। ঘর ভর্তি এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে। ওর নিজের। তারপরও কেউ দরজা খুলবে না। ওকেই গিয়ে খুলতে হল। ইকবাল একটু ওর দিকে তাকায়। যে দৃষ্টিতে তাকায় সেটাকে সাপের দৃষ্টির সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
এটা কেন মনে হল?
সে কি কখনো সাপের চোখের দিকে তাকিয়েছে? আসলে কিছু কিছু উপমা বই এ পড়ে সেগুলোকে আমরা বাস্তব জীবনের সাথে মিলানোর চেষ্টা করে থাকি। এটা ঠিক না।
দরোজায় দাঁড়িয়ে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয় নীলা, এবার একটা সাপের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করবে ওদের দৃষ্টি টা কেমন। সেটা কি ইকবালের চোখের দৃষ্টির সাথে মিলে কিনা তাও পরখ করবে...
‘ কি হল, সরো। ভিতরে ঢুকতে দাও’ ইকবালের কথায় সম্বিত ফিরে পায়। একটু সরে ওকে ঢুকতে দেয়। একটু লজ্জাও পায়। আর ওর ভিতরে ইকবালকে কেন্দ্র করে এখনো যে এই লজ্জা রয়েছে ভেবে অবাক হয়।
একটু আনন্দও কি জেগে উঠে মনের এক কোণায়?
ইকবাল কি মনে করে আবার পিছনে ফিরে আসে। অ্যাটাচি থেকে একটা খাম বের করে নীলার হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা তোমার’।
ব্যস।
এইটুকুই।
আজকাল এর বেশী কথা আর হয় না। ইকবাল ওর রুমের দিকে চলে যায়... পিছনে রেখে যায় প্রশ্নবোধক নীলাকে যার ভিতরে অনন্ত প্রশ্ন বিরাজ করছে, কিন্তু সেদিকে কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই ইকবালের।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় চলে যায় নীলা।
খামটা খোলে।
একটা আনন্দকে সাথে নিয়ে ভাললাগার অতীত যেন টাইমমেশিনে করে মুহুর্তেই হাজির হয় ওর বারান্দায়!! ওদের ব্যাচের পক্ষ থেকে মিলন মেলার ইনভাইটেশন কার্ড!
একটু ভাললাগা আর স্পেশাল একজনকে মনে পড়ে যায়।
মুহুর্তেই বিকেলটা ঝলমলে হয়ে গেল। আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!!!
... ...
বন্ধুরা একে একে আসছিল , নানান ভাবে তাঁদের আবেগ প্রকাশ করছিলো । নীলা হল রুমে ঢুকার দরজার কাছে পাতা একটা টেবিলে বসে দেখছিল । চেনা কেউ এলে উঠে এসে খুশি ভাগাভাগি করছিলো ... তাকে স্টেজের দিকে এগিয়ে দিয়ে আবার এসে টেবিলে বসছিল । সে যে এই দায়িত্বে আছে তা নয় । অনেকটা নিজের অজান্তেই প্রিয় একটা মুখ দেখার জন্য সেই অনুষ্ঠানের শুরু থেকে সে এখানে বসে আছে । এখানেই ঘুরে ফিরে থেকে যাচ্ছে ।
প্রায় দুপুর হয়ে গেলো । নীলা কিছুটা বিষণ্ণ বোধ করলো । হয়তো আসবে না। এতো বছর পর । নীলা কি ওকে চিনবে ? ছবিতে যেমন দেখায় সামনাসামনি তেমন হবে ? যদি এসে থাকে আর নীলা না চিনে থাকে ! কাউকে কি জিজ্ঞেস করা যায় ? ওদের কাছে ডিপার্টমেন্ট ভিত্তিক লিস্ট আছে । কে কে আসবে ।
নীলা টেবিল ছেড়ে দরজার সামনের ডেস্কটায় গিয়ে দাঁড়ালো ।
একটু নার্ভাস লাগছে ।
হাসলো ।
রিসেপশন এর দায়িত্বে কিছু স্কাউট আছে। স্কাউটরা বেশ আত্মবিশ্বাসী হয় । স্কাউট দের মধ্যে একজন স্বাভাবিক দৃপ্ততায় নীলার সামনে টেবিলের ঠিক ওপাশে হাসিমুখে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো , " কিছু করতে পারি আপনার জন্য ?
নীলা মৃদু হাসলো ।
'যারা আসবে তাঁদের নামের লিস্ট দেখতে পারি ?'
ছেলেটা মাথা খানিকটা নোয়ালো , 'জ্বী , অবশ্যই ... '
নীলা রেজিস্ট্রেশন করা নামগুলি পড়তে থাকলো ।
পরিচিত দুই একটা নাম পড়া হতেই একটা চেনা গালায় নিজের নাম শুনে ঘুরে দাঁড়ালো ... নাম মনে আসছে না ... হাসতে লাগলো নীলা ... বান্ধবী হাসতে হাসতে এসে নীলার হাত ধরল , ' নীলা , আমি মিমি , মনে নাই একদমই ! কেমন আছিস? আমার সাথে আমার দুই বাচ্চা আছে । একজন অসুস্থ , আনি নাই । তোর ছেলেমেয়ে আসে নাই ? ...' প্রশ্নের স্রোতে ভাসতে ভাসতে নীলার মেমোরি মিমির ইতিহাস খুঁজে পেলো । উচ্ছ্বল হয়ে উঠলো দুজন । কথার ফাঁকে ফাঁকে নীলার চোখ অন্য সব বন্ধুদের মধ্যে শিহাবকে খুঁজতে থাকলো । ' সত্যিই আসেনি !'
মিমি নীলার চোখের দিকে খেয়াল করলো , 'কাকে খুঁজিস?'
নীলার মুখ বন্ধ হয়ে কান লাল হয়ে গেলো । মিমি হেসে উঠলো।
' আয়'
নীলার হাত ধরে প্রায় টেনে নিয়ে গেলো স্টেজের পিছনে । মিলন , রেখা , শিহাব । নীলার রক্ত চলাচল ধীর হয়ে গেলো। হাসছিল তখনো । যার দিকে তাকিয়ে আছে তাকে দেখছে কিনা সন্দেহ । বাকিরা হাসছে তাও দেখছে না।
শিহাব স্বভাবসুলভ মৃদু স্বরে জানতে চাইলো ,' ভালো আছো?'
নীলাও প্রায় একই সাথে জিজ্ঞেস করলো ,' কেমন আছো '
প্রায় থেমে থাকা সময় থেকে তাদের ভাবনার স্রোত বয়ে গেছে অনেক বছর আগের কোন সময়ে ...
যে যার স্মৃতির ভিতর কোন অনুভূতিকে খুঁজতে খুঁজতে টুকিটাকি দু'একটা কুশল বিনিময় হতে থাকলো ।
আর কোনো কথা খুঁজে পায় না ওরা... কি বলবে ... কি বলা উচিত এই সময়গুলোতে?
লিখে ভাষা যত সহজে প্রকাশ করা যায়, সামনে এলে কেন যায় না?
দৃষ্টি কি অনেক বেশি কিছুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় মানুষকে ?
কি ভাবছে আধো আনমনা দুজন !
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০১২ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার লিখনির অসাধারণ ব্যন্জনায়- প্রায় থেকে থাকা সময় থেকে অনুভূতির স্রোতে ভাসতে ভাসতে অনেক অনেক আগের সময়ে কখন যে পৌছে গেছি- বুঝতেই পারিনি!!
আমিও ভাবছি.......কী..........
ধন্যবাদ সাথে থেকে অনুভূতি রেখে যাবার জন্য এবং সবসময়ের মত কিছু নান্দনিক মন্তব্য উপহার দেবার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ধন্যবাদ আপনাকে ব্লগে সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো বন্ধু
বুক ভরা ভালোবাসা দিলাম...চলবে...
খুব ভাল্লাগ্লো|ধন্যবাদ আপনাকে ভাইয়া|
দুঃখিত আপনাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখবার জন্য। বাকী দুটি পর্ব দু'ঘন্টা পর পর ছাড়া তো পোষ্ট করতে পারছি না। একসাথে পড়ে নিয়েন।
আপনাকে ধন্যবাদ সাথে থাকবার জন্য।
অনেক শুভেচ্ছা।
অনেক ধন্যবাদ ব্লগে অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
একদম সত্য বলেছেন। আর লেখাটা দারুণ হয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে এই অনুভূতিটুকু লাভ করেছি।
সাথে থেকে অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে।
সাথে থাকবার জন্য অনেক শুভেচ্ছা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন